আবুল মনসুর
অবিভক্ত ভারতবর্ষের চিত্র-ভাস্কর্যের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বলা যেতে পারে যে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এ সভ্যতাটির পরিচয় বিধৃত রয়েছে বিশেষত এর স্থাপত্যে, এর চিত্রে ও ভাস্কর্যকলায়। এ সকল শিল্পকৃতির প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা এসেছে সমাজের উচ্চকোটি থেকে, মূলত ধর্মের মহিমা অথবা শাসকমহলের বৈভবের প্রকাশ ঘটাতে। রূপায়নে বিভিন্ন পর্বে এসেছে বিবিধ শিল্পশৈলীর বৈচিত্র্য। এর পাশাপাশি বয়ে চলেছে প্রান্তিকজনের বৃহত্তর লোকজীবনের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রবাহ, তার পরম্পরাগত বৈশিষ্ট্যের রূপকে ধারণ করে। ঔপনিবেশিক শাসন এই ভৌগলিক কাঠামোর মধ্যে প্রোথিত করেছে তার নিজের সংস্কৃতির আঙ্গিক, বিশেষ করে চিত্র ও ভাস্কর্যে পশ্চিমের বাস্তবানুগ রূপায়নের ধারাটিকে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিই ভারতের প্রধান শহরগুলিতে স্থাপিত হয় ইউরোপীয় রীতির শিল্পশিক্ষার আর্ট স্কুল, সৃষ্টি হয় হুবহু রূপায়নের অপর একটি ধারা। এই দোলাচলের ভেতর দিয়ে রাজনীতি ও সামাজিক পটভূমির অভিঘাত ধারণ করে এগিয়েছে উপমহাদেশের আধুনিককালের দৃশ্যকলা। উপনিবেশ, দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এই যাত্রাপথে সঞ্চার করেছে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
জয়নুল আবেদিনের শিল্পপরিক্রমা এই তিনটি কালপর্বকেই স্পর্শ করেছে। তাঁর সৃজনকৃতির গৌরব ও গুরুত্ব কোথায় নিহিত তার পরিচয় কখনো স্পষ্ট আকৃতিতে পরিস্ফুট হয় নি। বিংশ শতকে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের দৃশ্যকলা জগতে জয়নুল আবেদিনের অবস্থানটি ছিল অন্য অনেকের চেয়ে পৃথক, আবার ধর্মীয় বিভাজনচেতনায় প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে চিত্র-ভাস্কর্য চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়িত্বেও তাঁর পথটি ছিল বন্ধুর। মাত্র ৬২ বছরের অবিশ্রাম সংগ্রামময় জীবনটি শুধুমাত্র নিজের শিল্পীজীবন গড়ার কাজে ব্যয়িত হয় নি, এটি বিস্তৃত হয়েছে পাকিস্তানের প্রতিকূল পরিবেশে একটি শিল্পশিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা ও শিল্পান্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষ্য নির্মান পর্যন্ত। এ লড়াইটি পর্যায়ক্রমে কী ভাবে তাঁর সৃজনকর্মে কেন্দ্রশক্তির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রান্তিক সমাজের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল বলা যায় জয়নুল আবেদিনের সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তাকে বুঝবার একটি খসড়া প্রয়াস এ নিবন্ধটি।
জয়নুল আবেদিনের লড়াই ছিল নানামুখী বিরূপতার বিরুদ্ধে। প্রথমত, পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়তে যাওয়া এক বাঙালি মুসলিম ছাত্র হিসেবে তাঁকে শুরুতেই লড়তে হয়েছে অনিচ্ছুক ও প্রতিকূল এক সমাজের বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক পূর্ববাংলায় তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বাস থাকলেও এর জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম যারা প্রধানত কৃষিজীবি, শিক্ষার আলোক-বঞ্চিত, কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদ চিন্তাচেতনায় আচ্ছন্ন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতার জোয়ালে বাঁধা তাদের মানসিকতায় পশ্চিমা শিক্ষা বা সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলাচর্চা ছিল ধর্মীয় অনুশাসন-বিরোধী কাজ। তিরিশ-চল্লি¬শের দশক বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাতন্ত্র্যচেতনা ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারের কাল। একদিকে স্বদেশচেতনা ও সৃষ্টিশীলতার প্রোজ্জ্বল আলোক, অন্যদিকে যুদ্ধ, দাঙ্গা ও ঘৃণার কালিমালিপ্ত তমস। এই পরিমন্ডলের ভিতর পূর্ববাংলার প্রায়- গাও গ্রামের এক মুসলিম পরিবার থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শিখতে এলেন জয়নুল আবেদিন, এটি সমাজগোষ্ঠির প্রথাগত ভাবনাবলয়ের বিরুদ্ধে ব্যক্তির একটি অবস্থান বটে।
অন্যদিকে দেশবিভাগের আগেই পূর্ব বাংলার হিন্দু সমাজের অনেকেই ছিলেন কলকাতার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সুপ্রতিষ্ঠিত ও নেতৃস্থানীয়। ভারতীয় আধুনিক চিত্র-ভাস্কর্যেও পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া শিল্পী যে ছিলেন না তা নয়, তবে স্বভাবতই এঁরা সবাই ছিলেন হিন্দুসম্প্রদায়ভুক্ত এবং পরবর্তীতে মূলত কলকাতা-কেন্দ্রিক। এঁদের মধ্যে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী (জন্ম রংপুর), হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার (জন্ম ময়মনসিংহ), মুকুল দে (জন্ম ঢাকা), অতুল বসু (জন্ম ঢাকা), মণিভূষণ গুপ্ত (জন্ম ঢাকা), পরিতোষ সেন (জন্ম ঢাকা) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা চলে। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের আগে সমগ্র ভারতবর্ষে পরিচিতিপ্রাপ্ত একমাত্র বাঙালি মুসলিম শিল্পী ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি থেকে আগত জয়নুল আবেদিন। জয়নুল আবেদিনের এই প্রান্তিক পটভূমি তাঁর শিল্প-বৈশিষ্ট্য রূপায়নে বিশেষ ছাপ রেখেছিল।
শিক্ষানবিশী পর্ব অতিক্রান্ত হওয়ার পর সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ-অনুসন্ধান জয়নুল আবেদিনের জন্য কঠিনই ছিল। পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ গ্রাম-সংস্কৃতির স্থবির জগৎ থেকে তিনি এসে পড়েছিলেন ভারতীয় রাজনীতি-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতার উত্তাল পরিমন্ডলে। ভারতীয় রাজনীতি তখন অদূরবর্তী স্বাধীনতার আবেগ ও উত্তেজনায় টলমল, আর সা¤প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্রমশ আচ্ছন্ন করছিল উপমহাদেশকে। এর বিপরীতে তাঁর অভিজ্ঞতায় ছিল পল্লীবাংলার সরল কর্মমুখর জীবনদৃশ্য আর কলকাতা আর্ট স্কুলের সাদৃশ্যবাদী অঙ্কনের শিক্ষা। সঙ্কটটি ছিল চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের স্বতন্ত্র পথ রচনার। তাঁর সম্বল ছিল রেখাঙ্কনে অতুলনীয় পারদর্শিতা, সঙ্গে জলরঙে চিত্ররচনার ঈর্ষণীয় দক্ষতা। পাঠ সমাপ্ত করার পর জয়নুলের সামনে সমসাময়িক রীতি হিসেবে ছিল প্রধানত ‘বেঙ্গল স্কুল’-প্রভাবিত কাব্যিক ভাবালুতা অথবা রোম্যান্টিকতায় মোড়ানো বাস্তবানুগ চিত্রাঙ্কন, অথবা স্বাদেশীক চেতনার পরিপূরক হিন্দু ধর্মীয় বা পৌরানিক উপাখ্যান কিংবা ইতিহাস বা সাহিত্যের কোন মহীয়ান ও আবেগঘন বিষয়। কলকাতা আর্ট স্কুলের, যেখানে জয়নুলের শিল্পশিক্ষা, শিক্ষার্থীরা প্রধানত আসতো শহুরে হিন্দু পরিবার থেকে যারা বিষয় হিসেবে মূলত চয়ন করতো ধর্মীয় বা পৌরাণিক ঘটনা, অথবা ভূদৃশ্য হলে কলকাতার নগরচিত্র, নয়তো রোম্যান্টিক সৌন্দর্যমন্ডিত প্রকৃতি। মহাযুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সচেতনতা চল্লিশের দশকেই এক ধরনের মোহভঙ্গের কারণ হয়েছিল এবং ভাববাদী সৌন্দর্যবোধ থেকে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে শিল্পীদের প্ররোচিত করেছিল।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে সমস্ত বাংলা জুড়ে অভাবিতপূর্ব এক মহামন্বন্তর বিপুল জনগোষ্ঠির জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। অনাহারে আর অপুষ্টিতে মারা যায় প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ। মহাযুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট এ মন্বন্তর শিক্ষিত বাঙালির মানসলোকে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তার স্বপ্নাবিষ্ট আর ভাবাবেগতাড়িত রোম্যান্টিক মানসভূমিকে অকস্মাৎ যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেল রূঢ় বাস্তবের তীব্র কষাঘাত। সাহিত্য-শিল্পকলা-সঙ্গীত-নাটকে এর অভিঘাত এসে পড়লো, প্রতিবাদী প্রতিফলন ঘটলো শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায়। অবশ্য বাম ভাবাদর্শিক রাজনৈতিক চেতনা ছিল এর পশ্চাতে প্রধান অনুপ্রেরণা। ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির প্রণোদনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ সালে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’ এবং ১৯৪৩ সালে ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’। বিশেষ করে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের উদ্যোগে নাটক ও সঙ্গীতের এক নব্য ধারার জাগরণ ঘটে। প্রায় একই সঙ্গে ১৯৪৩ সালেই দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার মাধ্যমে সর্বভারতীয় শিল্পজগতে স্বকীয় বিশিষ্টতায় জয়নুল আবেদিনের আত্মপ্রকাশ। তাঁর রেখাঙ্কনের অসামান্য দক্ষতার যোগ্য বিষয় যেন খুঁজে পেলেন অনাহান-লাঞ্ছিত মানব অবয়বের কাঠামোয়।
স্বাভাবিকভাবেই চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত শিল্পীরা এগিয়ে এসেছিলেন মন্বন্তর-সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের রূপায়নে। তবে এটি ছিল এমন এক সার্বিক ট্র্যাজেডি যা যে কোন সংবেদনশীল মানুষকে স্পর্শ না করে পারে নি। ফলে আমরা দেখতে পাই মন্বন্তরকে বিষয় করে প্রায় সকল প্রধান বাঙালি শিল্পী কিছু না কিছু সৃষ্টি করেছেন। তবে ইতিহাসের অন্যতম সেই মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয় যে তিনজন শিল্পীর হাতে বাস্তব অভিজ্ঞতায়, ক্ষোভ-ক্রোধ ও সত্যিকারের সহমর্মীতায় বিধৃত হয়েছিল তাঁরা হলেন জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও সোমনাথ হোর। উল্লেখ্য যে চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ উভয়েই ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ও সার্বক্ষণিক কর্মী এবং দুর্ভিক্ষের রূপায়ন তাঁদের কাছে ছিল প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক দায়িত্ব ও পুঁজিবাদী শোষণের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও উপস্থাপনের উপায়। এ ছাড়া শিল্পী হিসেবে দু’জনেরই অবস্থান ছিল গ্রামবাংলায়, বিষয়বস্তুর একেবারে অভ্যন্তরে। অন্যদিকে জয়নুল কোন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উপলব্ধির দ্বারা চালিত হন নি, তিনি এ চিত্রমালা অঙ্কনে প্রণোদিত হয়েছিলেন নিতান্ত ব্যক্তিগত মানবিক তাগিদ থেকে। দুর্ভিক্ষের বিপর্যয়কে তিনি দেখেছেন কলকাতার ফুটপাথে মানবতার চরম লাঞ্ছনার চিত্র রূপে। তাঁর চেনা পূর্ব বাংলার গ্রামের কিষাণকে, লাজনম্র পল্লীবধুকে কলকাতার রাস্তায় উদ্বাস্তু-বেআব্রæ হয়ে কুকুর-বেরালের মত মরতে দেখে নির্মম ও উদাসীন নাগরিক সভ্যতার প্রতি তীব্র ধিক্কারে আন্দোলিত হয়েছিলেন জয়নুল। তাঁর চিত্রমালা সে অনুভবের ফুঁসে ওঠা উদ্গীরণ আর কেন্দ্রশক্তির বিপরীতে প্রান্তস্থিত মানুষের পক্ষে তাঁর অবস্থানের একটি শক্তিমান সূচকও।
জয়নুলের রেখাচিত্রে ক্ষুধাদীর্ণ উদ্বাস্তু মানুষগুলোর শরীরের ভগ্ন-বিদীর্ণ প্রায়-জান্তব অবয়বে আর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের অপ্রাকৃত অভিব্যক্তিতে লাঞ্ছিত মানবতার রূপ যে তীব্রতায় প্রকাশমান হয়েছে তাতে এগুলি নিছক রেখাচিত্র বা তাৎক্ষণিকতার সীমা অতিক্রম করে চিরায়তের ব্যঞ্জনা অর্জন করেছে। ভগ্নদেহ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, বিপর্যস্ত-পরাজিত, তবু তাদের শরীর এক সমুন্নত বিপুলতায় অধিকার করে রাখে জয়নুলের সম্পূর্ণ পটের জমি। এখানে একদিকে যেমন রয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের লাঞ্ছনার অমানবিক দিক, তার ভিতরেই আবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও অন্ত্যজ মানুষের বাৎসল্য, আত্মত্যাগ ও পারিবারিক সহমর্মিতার মনুষ্যত্বমন্ডিত দিকটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন জয়নুল। এ ভাবে আমাদের নাগরিক খোলসের আড়াল ভেঙ্গে দেন তিনি, সামনে দাঁড় করিয়ে দেন তাঁর গ্রামীন কিষাণের মুখচ্ছবি আর ঐ সব ক্লিষ্ট মানুষের ললাটে এঁকে দেন অপরাজেয় মানব-অস্তিত্বের জয়টিকা। তাঁর দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালার ভিতরেই সমন্বিত ছিল অন্তর্নিহিত এক প্রকাশশক্তি ও শিল্পোৎকর্ষ। এই চিত্রমালাই তাঁকে বাতলে দিয়েছে পথ, যে পথে অগ্রসর হয়ে তিনি উপমহাদেশীয় শিল্পঐতিহ্যে অন্ত্যজ শ্রেণীর গ্রামীন মানুষ ও প্রকৃতির এক নবতর ভাষ্য নির্মানে প্রয়াসী হয়েছেন।
যদিও দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালা তাঁকে এনে দিয়েছিল খ্যাতি, তবুও কলকাতার জীবনে মহানগরীর স্পন্দিত সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে মানুষটি ছিলেন এক প্রতিভাবান তরুণ চিত্রকর মাত্র, ৪৭-এর দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চারুশিল্প চর্চার মোটামুটি শূন্য অবস্থা থেকে একটি শিল্প-আন্দোলন শুরু করার গোটা দায়িত্বটাই এসে পড়ে তাঁর কাঁধে, বলা চলে কর্তব্য বিবেচনায় তিনি নিজেই তুলে নিয়েছিলেন এ দায়ভার। তখন তাঁর বয়স মাত্র তেত্রিশ। তৎকালীন অনগ্রসর, ধর্মীয় সংস্কার-আচ্ছন্ন এবং শিল্পচর্চার বিশেষ কোন নাগরিক ঐতিহ্যবিহীন পূর্ববঙ্গে এটি ছিল তাঁর একার একটি অসম লড়াই জয় বা বৈপ্লবিক কীর্তি এবং এ জন্য জয়নুল আবেদিনের প্রতি কোন সাধুবাদই যথেষ্ট নয়। গোটা পাকিস্তানপর্ব জুড়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও সা¤প্রদায়িক ভেদনীতির বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রাম নানান ঐতিহাসিক ঘটনায় আজ মহিমান্বিত। চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন পাকিস্তান-পর্বে তাঁর নিজস্ব কী অভিব্যক্তিতে কেন্দ্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রান্তিক মানুষের লড়াইকে বিবৃত করেছেন সেটি লক্ষ্য করবার মত বটে।
পঞ্চাশের দশক জুড়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং অসা¤প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির উন্মেষের কাল যা আজ প্রতীকায়িত একুশে ফেব্রæয়ারীর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। এই বিকাশমান পটভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং পঞ্চাশের গোড়াতেই বিদেশে প্রশিক্ষণ ও ভ্রমণের সুযোগ জয়নুলের মানসগঠন ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। আমরা লক্ষ্য করি পঞ্চাশের দশক তাঁর সৃজনশীলতার অন্যতম ফলপ্রসূ কাল। দেখা যায় ১৯৫১-৫২ সালে প্রথমবারের মত য়ুরোপ ভ্রমণ ও লন্ডনের স্কুল অব আর্টস-এ কাজ করার সুযোগ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন সূচীত করল সেটি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমের সমসাময়িক চিত্রধারার সাথে এ-ই তাঁর প্রথম সরাসরি পরিচয়। সাদৃশ্যরূপ ছেড়ে ফর্মের জ্যামিতিক বিভঙ্গ তাঁকে আকৃষ্ট করল, শিল্পে রূপের অতিশায়ন বা অতিরঞ্জনের প্রয়োগ সম্পর্কে এল সচেতনতা । তবে, তাঁর বয়োকনিষ্ঠদের মত এই নবলব্ধ উপলব্ধি তাঁকে পাশ্চাত্যমুখী না করে বরং করে তুলল আরো অন্তর্মুখী। বিদেশের মাটিতে বসে যেন তিনি আবিষ্কার করলেন স্বদেশের মুখ। দেশজ শিল্পের পরম্পরার মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন অমিত সম্ভাবনা, একে সমকালের শিল্প-আঙ্গিকে প্রয়োগের অনুপ্রেরণা। এ বিশিষ্টতা জয়নুলের মানস-রূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতিভাত করে যা আবারো তাঁর প্রান্তমুখী শৈল্পিক আকাঙ্খাকে অনুধাবন করায়।
১৯৫১ সালে আঁকা দড়ি ছেঁড়ার তীব্র প্রয়াসে ধাবমান গরুর শক্তিমান অভিব্যক্তিটি এ প্রসঙ্গে উল্লে¬খ করা যেতে পারে। এখানে মানুষ নয়, একটি গাভীর সর্বশক্তি দিয়ে দড়ির বন্ধনকে ছিন্ন করবার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে জয়নুল কী পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিরর্থকতা ও এর নিগঢ় থেকে মুক্তির প্রত্যয় ব্যক্ত করেন? উল্লে¬খ্য যে, প্রাণীটি যেখানে ষাঁড় হওয়াই অধিকতর প্রত্যাশিত ছিল সেখানে তিনি আঁকেন দুগ্ধবতী গাভীর দ্রোহ, এবং একে তিনি ফিরে ফিরে আঁকেন, বারে বারে। এ কী তাঁর তুলিতে প্রতীকী দেশমাতৃকা, একইসঙ্গে শক্তিরূপিনী ও অন্নদাত্রী? মই দেওয়ার দৃশ্যে যেমন, তেমনই ব্রহ্মপুত্র নদী পারাপারের জন্য অপেক্ষারত ছবিতে দেখি পিতা-পুত্রের পরষ্পরনির্ভরতা, গ্রামীন কৌমসমাজের পারিবারিক বন্ধনের মাধুর্যময় রূপ। দেখা যায় সংগ্রাম চিত্রটি তিনি ২০ বছরেরও অধিক ব্যবধানে প্রায় হুবহু একই রূপে দু’বার অঙ্কন করেছেন একবার ১৯৫৪-এ, আরেকবার ১৯৭৬ সালে। প্রকৃতির বৈরীতার বিরুদ্ধে জীবনের লড়াই গোড়া থেকেই জয়নুলের শিল্পভাবনার প্রধান অবলম্বন যা রূপকাশ্রিত হয়ে অশুভের বিপক্ষে শুভের সংগ্রামকে প্রতিভাত করে। সংগ্রাম ছবিতে মানুষই শুধু নয়, পশুও সামিল হয় সে যুদ্ধে, অর্থাৎ জীবনের সকল প্রতিভু যোগ দেয় সে মরণপণ লড়াইয়ে। বৈরীতার কাদায় আটকে গেছে জীবনের শকট, তাকে টেনে তুলে অগ্রসরমান রাখতে লড়তে হবে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে। আর এর বিপরীতে জীবন প্রগতি, চলিষ্ণুতা, সংস্কারমুক্ত মানবিক বোধের দ্যোতক। এখানেও জয়নুল শাসকগোষ্ঠির কেন্দ্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে হাজির করেন প্রান্তিক মানুষের বিকল্প সামর্থ্যকে।
তাঁর স্বদেশ-অনুসন্ধানের অভীপ্সা আরো শিকড়-প্রয়াসী হয়েছে লোককলাকে আশ্রয় করে চিত্রনির্মান প্রয়াসের মধ্যে। পশ্চিমা সাদৃশ্যপন্থার ঘেরাটোপ থেকে একেবারেই মুক্ত হয়ে বাঙালির লোকশিল্পের দ্বারা প্রাণিত হয়ে কিছু চিত্র নির্মান করেছেন তিনি ১৯৫২-৫৩-তে একবার, ১৯৭২-৭৩-এ একবার। ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালির আত্ম-আবিষ্কারের উদ্বোধন হয়তো এতে প্রণোদনা যুগিয়ে থাকবে। লোককলার প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ সত্তে¡ও এর ফর্মুলাবদ্ধ ও স্থানু শৈলী তাঁকে বেশিদিন আকর্ষণ করতে পারে নি। তবু এমনটি বলা যায় যে লোকশিল্পের আঙ্গিককে অবলম্বন করে তাঁর নিরীক্ষার মধ্যে সম্ভাবনার লক্ষণ ছিল। কিছু কিছু চিত্রে, যেমন পাইন্যার মা বা গুণটানায়, উলম্ব ও আনুভূমিক রেখার জোরালো জ্যামিতিক বাঁধন ও অবয়বের সমুন্নত বিস্তার এক ধরনের মহিমাব্যঞ্জক পরাক্রম সঞ্চার করে। তবে লোককলার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইতিহাসখ্যাত সোনারগাঁও-এ বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে।
জয়নুল ভূমিপুত্র পল্লীবাসীকে রূপায়িত করেছেন নিসর্গলগ্ন করে, তাকে বেষ্টন করে থাকা নিসর্গের সাথে অবিরাম সহাবস্থান ও সংঘর্ষের মধ্যে। ঊনসত্তরের গণজাগরণ নাড়া দিয়েছিল সকল বাঙালির চেতনার শেকড় ধরে। আন্দোলিত হয়েছিলেন শিল্পীও। বহুকাল পর জয়নুল যেন হাতে পেলেন তাঁর প্রত্যাশিত মাপের বিষয়। আঁকলেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ নবান্ন চিত্র। এখানেও তিনি সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য এড়িয়ে বাঙালি-জীবনের এক আদ্যোপান্ত চিত্র তুলে ধরলেন জড়ানো পটের রীতিতে। উনসত্তরের গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে সম্প্রদায়-চিহ্নহীন বাঙালিজীবনের আনুপূর্বিক এক বয়ান উপস্থাপন করে গণজাগরণের চেতনার সমান্তরাল বোধকে বিবৃত করলেন তিনি। প্রকৃতির পটভূমিতে চিরকালের বাঙালির কান্না-হাসি-সংগ্রামের সেই চলমান ছবির মধ্যেই যেন মূর্ত হয়ে উঠলো তার আত্ম-পরিচয়ের নির্যাস। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিবাত্যা তাঁকে আলোড়িত করবে প্রবলভাবেএটিই স্বাভাবিক। আঁকলেন ৩০ ফুট দীর্ঘ মনপুরা’৭০ স্ক্রলচিত্র। এখানে আবার দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার স্মৃতি যেন জাগরিত হলো। দুর্ভিক্ষ-চিত্রে যেমন ক্লিষ্ট পরাস্ত মানুষগুলিও এক মন্যুমেন্টাল অবস্থিতি গ্রহন করে তেমনই মনপুরা চিত্রের গলিত মৃতদেহগুলি পর্যন্ত যেন পুঞ্জ-পুঞ্জভাবে ঊর্ধ্বমুখে ফুঁসে উঠতে চায়, মৃতের উত্থিত হাতের ভঙ্গিতে যেন প্রতীকায়িত হয়ে ওঠে প্রত্যাঘাতের প্রতিজ্ঞা। এ দু’টি শিল্পকর্মে জয়নুল শুধু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকেই প্রতিভাত করেন না, বাংলার জড়ানো পটের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে বক্তব্যকে বর্ণনাত্মক বা ন্যারেটিভ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে দেশজ সংস্কৃতির শেকড়ের সঙ্গেও একাত্মতা জ্ঞাপন করেন। এ ভাবে প্রকৃতির একইসঙ্গে শ্রীময় ও করাল রূপ এবং তার সঙ্গে গ্রামীন ভূমিসংলগ্ন জীবনের এ আদিম ও দ্বান্দিক অবস্থান জয়নুলের চিত্রে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী রূপকল্প হিসেবে বিধৃত হয়েছে। এটিই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। রাজনীতির কোন গৎবাঁধা তত্তে¡ নয়, এই অপরাজেয় শাশ্বত মানবসত্তার প্রতি দায়বদ্ধতার মধ্যেই জয়নুলের রাজনৈতিক চেতনাকে অনুধাবন করতে হবে।
তাঁর সৃজনকর্মে রেখার পরাক্রমই জয়নুলের শক্তি ও স্বকীয়তার অভ্রান্ত চিহ্ন। তিনি এসেছিলেন পূর্ব বাংলার গ্রামীন উৎস থেকে এবং নাগরিক শুদ্ধির মধ্যে ক্রমাগত অবস্থানও তাঁর এই গ্রামীনতা কেড়ে নিতে পারেনি। শিল্পেও তিনি সঞ্চার করতে চেয়েছেন এক প্রবল ও বেগবান গ্রামীনতা। এ জন্য জয়নুলকে উদ্ভাবন করতে হয়েছে একটি ভিন্ন ও মিশ্রিত শিল্পরূপ। স্বাভাবিক ও বাস্তব আকৃতি এবং পশ্চিমা রীতির রং ও আলোছায়ার বিতরণের পাশাপাশি বস্তুর বহিঃরেখায় তিনি যোজনা করলেন শক্তিশালী ও বেগবান তুলির আঁচড় যা বস্তুর কাঠামোকে একই সঙ্গে আকৃতি, শক্তি ও বেগ দান করলো। জাপানি ও চিনা রেখাচিত্রের স্বতস্ফ‚র্ততা এবং সাদা চিত্রতলে শক্তিশালী কালো রেখার যে নাটকীয় আবেদন জাপানি ও চিনা শিল্পীরা ঘটান খুব সম্ভবত তা জয়নুলের দৃষ্টি এড়ায় নি। অন্যদিকে বাংলার লোকচিত্রেও রেখার অসাধারণ চলিষ্ণুতা তাঁকে নিশ্চয়ই আকৃষ্ট করেছে। অতএব, জয়নুলের রেখাকে বিশেষ কোন একটি রীতির বা প্রকারের আওতায় বিচার করা চলবে না। পাশ্চাত্য শিল্পরীতি, বেঙ্গল স্কুলের প্রভাব, দেশজ লোকশিল্প, চীনা ও জাপানি রেখার আকর্ষণ এসব মিলেই হয়তো তৈরি হয়েছে জয়নুলের নিজস্ব রীতি। এই রেখা এত বাক্সময় ও প্রাণবান যে দুর্ভিক্ষের স্কেচসমূহে অথবা মনপুরা স্ক্রলে রঙের ব্যবহার ছাড়াই এগুলো প্রবল মানসিক প্রতিক্রিয়া তাড়িত করতে পারে।
এই উপমহাদেশের শিল্পধারায় রোম্যান্টিকতার রেশ ছিন্ন করে জীবনের শ্রমমগ্ন বাস্তবিকতায় উত্তরণ, ধর্ম-প্রভাবিত বিষয়ের নিগঢ় থেকে অসাম্প্রদায়িক মানবিক ধারার সূচনাপর্বে জয়নুল আবেদিন এক অগ্রপথিকের নাম। তাঁর সৃষ্টিতেই প্রবল শক্তিময়তায় প্রকৃতি ও মানুষ দেখা দিল একদিকে নির্মম বাহুল্যহীন বাস্তবতায়, অন্যদিকে গতি ও শক্তির প্রখর প্রয়োগে বাস্তবের এক ভিন্নতর দ্যোতনায়। গ্রামীন জীবনের সরল সৌন্দর্য্যরে পুন পুন রূপায়নে জয়নুল আবেদিন জানান দেন তাঁর প্রতিবাদকে, প্রত্যাখ্যানকে, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সা¤প্রদায়িক ভেদনীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে। এভাবে জয়নুল আবেদিন তাঁর শিল্পবোধ ও জীবনোপলব্ধির যৌগক্রিয়ায় এ অঞ্চলের শিল্প-ইতিহাসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবন-সংগ্রামের এক ভিন্ন ও শক্তিমান চিত্ররূপ রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।